প্রকাশিত: Sat, Jun 1, 2024 3:42 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 11:47 PM

অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা : বটবৃক্ষের ছায়া

ড. সেলিম জাহান

বহুদূর থেকে ভেসে আসে একরাশ কথাÑ কোনো একজনের কিছুটা ভাঙ্গা ফ্যাঁস ফ্যাঁসে গলায় যা, ভাগ এখান থেকে, শুধু শুধু কাজে বাগড়া দিচ্ছে, এতো বকর বকর করলে এখানে থাকতে দেব না, এই ছেলে, রোদ থেকে ছায়ায় সরে আয়, শোন চা খাবি আমার সঙ্গে? কতদিন আগের কথা? তা প্রায় পয়ষট্টি বছর আগে তো হবেই। খুব সম্ভবত: ১৯৬০ সালের কথা। আমি তখন নিতান্তই বালক। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের এক নিসর্গপ্রেমিক অধ্যাপক পাগলের মতো মেতে উঠেছিলেন সারা কলেজ এলাকাকে গাছে গাছে ভরে দেবেন। আমি তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরতাম। আমাকে উদ্দেশ্য করেই তাঁর ওই সব বাক্যবান। ওপরে ওপরে তাঁকে খুব রাগী মনে হতো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভারী নরম একটি স্নেহপ্রবণ মন ছিল তাঁর। ছোটরা ওই আদরটা সহজে বুঝতে পারে। 

আমার অধ্যাপক বাবার তরুণ সহকর্মী ছিলেন তিনি-তখনও তিনি অকৃতদার। কলেজের খুব কাছে আমাদের বাড়িতে আসতেন তিনি। এসেই তিনি গাছের গল্প জুড়ে দিতেন। আমার বাবারও প্রচণ্ড বৃক্ষপ্রীতি ছিল। সুতরাং দুই অসম বয়সী সহকর্মীর মধ্যে গল্প জমে উঠত। বুঝেছেন স্যার, গাছে গাছে আমি ছেয়ে দেব সারা কলেজ প্রাঙ্গন, বলতেন তিনি বাবাকে। বাবা মৃদু হাসতেন। তাঁর ওই যে গাছে গাছে ছেয়ে দেব ওই কথাটাই বালক আমাকে অভিভূত করেছিল। একটা লোক অত বড় একটা এলাকাকে কী করে গাছে গাছে ছেঁয়ে দেবে তা আমি বুঝতে পারতাম না। অচিরেই শুরু হয়ে গেল তাঁর কাজ-তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন। চারা গাছ এলো, সার এলো, লোক এলো এবং তার সাথে উৎপাতও এলো। মানুষ জমে যেত তার কাজ দেখতে।

বিরক্ত হতেন ভীষণ, কাজের সময়ে ভিড়-বাট্টা একদম পছন্দ করতেন না। তাড়া দিতেন লোকজনকে। একটু দাঁড়িয়ে মজা দেখে কিছুক্ষণ পরে সরে পড়ত তারা একে একে-একমাত্র একটি অর্বাচীন বালক ছাড়া। তাঁর কাজের প্রতি একটি বালকের মুগ্ধতা তিনি বুঝতে পারতেন। তাই অসম বয়সী আমাদের মধ্যেও একধরনের সখ্য গড়ে উঠেছিল। আমাকে গাছ চেনাতেন তিনি, চেনাতেন ফুলও। কোন গাছে কতটা মাটি দিতে হবে, কতটা সার লাগবে, জলেরই বা দরকার কতটুকু-সব বোঝাতেন তিনি। কিন্তু চুপ করে কথা শোনা আমর কম্মো নয়। তাই আমি অনবরত উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতাম। তাতে বিরক্ত হতেন না তিনি। কিন্তু ভীষণ বিরক্ত হতেন যখন গাছ মাটিতে পোঁতা হচ্ছে তখন কথা বললে। সে সময়ে বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারি ওই বৃক্ষরোপন ছিল তাঁর কাছে উপাসনার মতো। কাজ করতেন মূলত ছুটির দিনে-সকালে শুরু করতেন, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ পেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত। একেক দিন কলেজের একেক এলাকায়। আমি নিয়মিত হাজিরা দিতাম। রোদ তেতে উঠলেই ধমকে আমাকে ছায়ায় পাঠাতেন। আরও বেলা বাড়লে বাড়িতে। আমি না যেতে চাইলে বাবাকে নালিশ করে দেবার ভয় দেখাতেন। মাঝে মাঝে অবশ্য আমাকে ছায়ায় ডেকে নিতেন। চা ভাগ করে দিতেন। কলা দিতেন মাঝে মাঝে মনে আছে। আর কি এক স্নেহমাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন তাঁর রোপিত গাছগুলোর দিকে। একটি গাছ অবশ্য আমাকে তিনি রোপন করতে দিয়েছিলেন। ছাত্রী মিলনায়তনের ফটকের সামনে একটি এ্যাকাসিয়ার চারা। কিছুদিন পরে শুনলাম তিনি ঢাকায় নটরডাম কলেজে শিক্ষকতা করতে যাচ্ছেন। 

একদিন চলেও গেলেন। কিন্তু সত্যি সত্যি ব্রজমোহন কলেজকে তিনি গাছে গাছে ছেয়ে দিয়ে গেলেন। বছর আটেক বাদে আমি যখন ওই কলেজেরই ছাত্র, ততোদিনে ওই  এ্যাকাসিয়া গাছটি ফুলে পত্রে নবীন যৌবনা। এ গাছটি আমার লাগানো এ কথা বলে আমার অনেক সহপাঠিনীকে মুগ্ধ করতে চেয়েছি। লাভ হয়নি কিছু। তারা হেসেছে শুধু, এক ফোঁটা বিশ্বাস করে নি আমাকে আশির দশকে এক বাঈশে শ্রাবণে তাঁর সঙ্গে দেখা নিউ মার্কেটে জিনাত বুক স্টোর্সে। তারিখটি মনে আছে, কারণ সেইদিনই ‘সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন চিন্তা নামে আমার একটি পূর্ণ পৃষ্ঠা দীর্ঘ প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন আমাকে দেখে। 

আমার লেখাটির প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন। সবার খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন। তারপর তাঁর স্মৃতি আমার কাছে ফিকে হয়ে এসেছে। আমার বয়স ও জগৎও বিস্তৃত হয়েছে। শুনতে পেয়েছি যে তিনি মস্কো চলে গিয়েছেন প্রগতি প্রকাশনীতে কাজ নিয়ে। 

মনে পড়েছে ওই সংসহায় ননী ভৌমিক কাজ করতেন। পরে অধ্যাপক হায়াৎ মামুদও সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি যখন দেশে ফিরে এলেন, আমি তখন দেশের বাইরে। বিদেশে ভুলেই গিয়েছিলাম তাঁর কথা। কিন্তু স্নেহভাজন সাদিয়া মাহজাবীন ইমাম তাঁর কথা উল্লেখ করেছিল একটি লেখায়। সাদিয়াও গাছ ভালবাসে। ওই লেখার সূত্র ধরেই অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার কথা আর তাঁর স্মৃতি যেন ফলগুধারার মতো বেরিয়ে এলো। আসলে স্মৃতিরা মরে না, তারা শুধু লুকিয়ে থাকে। ২৯ মে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার জন্মতিথি। 

বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ৯৫। যখনই আমি তাঁর কথা ভাবি, তখনই পয়ষট্টি আগের ওই ছবিগুলোই ভেসে আসে। বলতে ইচ্ছে করে, আপনি চলে গেছেন, কিন্তু বরিশালে বি.এম. কলেজে আপনার গাছেরা কিন্তু আছে। তিনি প্রায়শই আমাকে রোদ থেকে ছায়ায় সরে যেতে বলতেন। আজ প্রয়াত অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে আমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কোন ছায়ায় আমি সরে যাবো স্যার?  বটবৃক্ষের ছায়া যে আর নেই। লেখক: অর্থনীতিবিদ